ইস্তানবুলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সী অব মারমারায় বেশ কয়েকটি দ্বীপ আছে। ডলমাব্যাচে রাজপ্রাসাদের কাছেই একটি বন্দর আছে। সেখান থেকে নিয়মিতভাবে প্রতি ঘণ্টায় জাহাজ ছাড়ে। টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার সময় ডালিমের জুস খেলাম। ইস্তানবুলের প্রতিটি রাস্তায়, মোড়ে ডালিমের সমারোহ। কেউ আস্ত ডালিম আর কেউ হয়তো সেই ডালিমের বেহেশতি নির্যাস বিক্রি করছে। এছাড়াও আছে নানান ধরনের মিষ্টি খাবার; যেখানে ডালিম ব্যবহার করে তারা। ডালিমের সেই নির্যাস খেতে খেতে দেখি জাহাজ এসে হাজির। ঘণ্টা দেড়েকের মতো সময় লাগে দ্বীপমালায় পৌঁছতে। বসফরাসের মাথা থেকে যাত্রা শুরু করে সী অব মারমারায় প্রবেশ করি। প্রথমে দূর থেকে দ্বীপমালা আবছাভাবে বোঝা যায় যে, ওখানে কিছু একটা আছে সমুদ্রের মধ্যে। ধীরে ধীরে দ্বীপগুলো আকারে বড় হতে থাকে।
প্রাচীন সময়ে এই দ্বীপমালাকে ডেমোনিসিয়া বলা হতো। এর মানে জনতার দ্বীপমালা। রোমান সাম্রাজ্যের সময়ে ধর্ম সন্ন্যাসীরা এ দ্বীপমালায় এসে হাজির হয় এবং ছোট ছোট আশ্রম তৈরি করে। তখন থেকে দ্বীপমালার নাম হলো পাপাডোনিসিয়া অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের দ্বীপমালা। দ্বীপগুলোর মধ্যে একটি অনেক বড়, অন্যগুলো এর থেকে ছোট। বড় দ্বীপটায় যুবরাজ জাস্টিন জুনিয়র ধর্মাশ্রম বানান। সে সময় বড় দ্বীপটিকে মেগ্যালে নামে চিনতো সবাই। মেগ্যালে অর্থ বিশাল, কিন্তু সম্রাট এখানে আশ্রম বানানোর পর এর নাম হয় প্রিঙ্কিপো অর্থাৎ যুবরাজের দ্বীপ। তখন থেকে সবগুলো দ্বীপকে একসাথে বলা হতো প্রিঙ্কিপোনিসস অর্থাৎ যুবরাজের দ্বীপমালা, ইংরেজিতে প্রিন্সেস আইল্যান্ড। বর্তমানে দ্বীপমালাকে প্রিন্সেস আইল্যান্ড নামে চেনে সবাই। একটিকে ‘বড় দ্বীপ’ আর দ্বিতীয়টিকে ‘দ্বিতীয় বড় দ্বীপ’ বলা হয়।
আমরা বড় দ্বীপ (বুউক-আদা) নামার পর দেখলাম, বন্দরজুড়ে বিভিন্ন রকমের স্যুভেনির আর খাবারের দোকানে ভরা। একপাশে সুদৃশ্য সী অব মারমারা, পাশেই দ্বিতীয় দ্বীপ আর অনেক দূরে সমুদ্রের ওপারে আবছাভাবে দেখা যায় ইস্তানবুল। অদ্ভুত এক অনুভূতি হয় দ্বীপে নামার পর। এই দ্বীপে ট্যুরিস্ট ছাড়াও সাধারণ নাগরিকরা বাস করে এখন। সবচেয়ে মজা হচ্ছে দ্বীপে সুন্দরভাবে বানানো রাস্তা আছে কিন্তু কোনও গাড়ি নেই। এখানে সবাই পায়ে হেঁটে অথবা ব্যাটারি চালিত স্কুটি ব্যবহার করে। শুধু অ্যাম্বুলেন্স, মালামাল বহনের আর সরকারি কিছু সংস্থার গাড়ি। যেমন- বিদ্যুৎ, পানি, ময়লার গাড়ি। এছাড়া ঘোড়ার গাড়ি আছে যা বেশিরভাগ ট্যুরিস্টরা ব্যবহার করে দ্বীপের অন্যপাশের চার্চ- আয়া ইয়র্গিতে যাওয়ার জন্য অথবা দ্বীপ ঘুরে দেখার জন্য। দ্বীপের বন্দর থেকে আমরা হেঁটে রওনা হলাম আয়া ইয়র্গিতে যাওয়ার জন্য। যেহেতু আয়া ইয়র্গি চার্চটা দ্বীপের অন্য দিকে সুতরাং এই উদ্দেশ্যে পুরো দ্বীপটা হেঁটে দেখা হবে। হেঁটে যাওয়ার মূল কারণ ছিল ভিন্ন।
এই দ্বীপে ঘোড়ার গাড়িতে একটি ঘোড়াকে কাজে লাগানোর দুই বছরের মধ্যে ঘোড়াটি মারা যায়। প্রতি বছর এভাবে প্রায় চারশ ঘোড়া মারা যাচ্ছে। এটি অফিসিয়াল হিসাব, কিন্তু আনঅফিসিয়াল হিসাবে এ সংখ্যা সাতশ থেকে আটশ। ঘোড়াগুলো সারাদিন ট্যুরিস্টদের নিয়ে চলাচল করার কারণে ঠিকমতো খাবার পায় না, বিশ্রাম পায় না। স্থানীয় খবরের কাগজে এ ব্যাপারে সংবাদ ছাপা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু ট্যুরিস্টরা সবাই তো আর এসব স্থানীয় খবর পড়ে না। তারা জানেনও না যে, তাদের কারণে প্রতিবছর চারশ থেকে আটশ ঘোড়ার অপমৃত্যু ঘটছে। এ জন্য ঘোড়ার গাড়িতে না গিয়ে হেঁটে দ্বীপ দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
যেহেতু এ দ্বীপে আমার শ্বশুর বাড়ি না, তাই এটি আমার অচেনা দ্বীপ। তবে গুগল মামার কারণে দ্বীপ চিনে চলার ব্যবস্থা হলো। ম্যাপে আয়া ইয়র্গিকে আমাদের গন্তব্য ঠিক করে দিতে অনুরোধ করলাম, মামা! আমাদের একটু এখানে নিয়ে চলেন তো!। গুগল মামা একেবারে হাতে ধরে আমাদের নিয়ে চললেন। একসময় সম্রাট, সম্রাজ্ঞীরা আর যুবরাজরা হেঁটেছেন যেই পথে, গুগল মামা আমাদের সেইসব পথ দিয়ে নিয়ে চললেন। ধীরে ধীরে রাস্তা উঁচু হওয়া শুরু হলো। বেশ খাড়া হয়ে উঠে গেছে গাড়িহীন পাহাড়ি রাস্তা দু’পাশে অসম্ভব সুন্দর সব বাড়ি-ঘর রেখে। প্রতিটা বাড়ির বারান্দা, চাতাল, বাগান, গেট দেখলেই মনে হয় বাকি জীবন এখানেই পার করে দেই। অনেক বাড়ি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। কিন্তু বাড়িগুলোর জৌলুশ এখনো বহাল আছে। মাঝে মাঝে ট্যুরিস্টদের নিয়ে টগবগ টগবগ করে ঘোড়ার গাড়িগুলো চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে। হাঁটছি আর উপভোগ করছি ভয়ঙ্কর সুন্দর দ্বীপ। চারিদিকে প্রান্তহীন সমুদ্র আর তার উচ্ছ্বাসমাখা ঢেউ, বিশাল নীলাকাশ আর বিরামহীন নিস্তব্ধতা। একেবারেই সুনসান পরিবেশ। গুগল মামা আমাদের যে পথে নিয়ে গেল এক পর্যায়ে দেখলাম একমাত্র আমরাই সেই পথের পথিক।
উঁচু পাহাড়ি এক রাস্তায় প্রবেশ করলাম। চারিদিকে জলপাই, বাবলা, সাইপ্রেস আর পাইন গাছের সারি। অনেক নিচে থেকে উঁচু পর্যন্ত সারি সারি গাছগুলো এসে মিশেছে উঁচু হয়ে আকাশ ছুঁয়ে যাওয়া পাহাড়ি রাস্তায়। দেখলেই মনে হয় যেন স্বর্গে চলে এসেছি। কিছুদূর পরে পরে কয়েকটা ঘোড়া সেই বনের মধ্যে চলছে নীরবে, তাদের কণ্ঠে নেই কোনো হ্রেষাধ্বনি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দূরে দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের নীলচে আভাস। পথের দুই পাশে কিছুদূর পরে পরেই বিশ্রামের জন্য সুদৃশ্য বেঞ্চ, পার্ক বানিয়ে রাখা। মাঝে মাঝে বিশ্রাম নেওয়ার কারণে গুগল মামার হিসেবে ৪৫ মিনিটের হাঁটা পথ আমরা মোটামুটি এক ঘণ্টায় পার হলাম।
এতো উঁচুতে আর এই গহীন জঙ্গলে আয়া ইয়র্গি চার্চটা কে বানিয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস নেই। তবে ধারণা করা হয়, ৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে এই চার্চ নির্মাণ করা হয়। ভেতরে ছোটখাট মিউজিয়ামের মতো, যেখানে রাখা আছে বিভিন্ন সম্রাটের আর যাজকের সীল, তাদের ব্যবহার করা কারুকাজ করা বিভিন্ন পাত্র, তরবারি আর কিছু পেইন্টিং। রোমান সম্রাজ্ঞী আইরিন বাইজান্টাইন শাসন করতেন এক সময়। তার ছেলে কনস্টানটিন-৬ দশ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন আর আইরিন দেশ শাসন করেন।
ফিচার বিজ্ঞাপন
কুয়ালালামপুর-গেন্টিং ৩দিন ২ রাত
মালয়শিয়া-সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড ৭দিন ৬ রাত
তুরস্ক ভিসা (বিজনেসম্যান)
কনস্টানটিন যখন বড় হয়ে দেশ শাসনের ভার নেন; তখন কয়েক বছরের মধ্যেই তার শাসন ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তার শাসনের সময় তিনি তার মা আইরিনকে প্রাসাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেন। যেহেতু তার শাসন ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তাই পরে তার মা এ ক্ষমতা ফিরিয়ে নেন নিজের হাতে। তখন কনস্টানটিন তার মাকে সহ-সম্রাটের মর্যাদা দেন। এক পর্যায়ে আইরিন তার সহযোগীদের সাথে নিয়ে কনস্টানটিনকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। কনস্টানটিনকে অন্ধ বানিয়ে দেন তার নিজের মা এবং তাকে এ দ্বীপে পাঠিয়ে দেন। কয়েক বছর পরে দ্বীপেই কনস্টানটিন মারা যান। পাহাড়ি পথে হাঁটার সময় অনেক দূরে ভাঙা মঠ দেখেছি। শুধু ভাঙা দেয়াল পড়ে আছে এখন। যা এখন ঘোড়ার আস্তাবল। এই মঠের চত্বরেই কনস্টানটিনকে কবর দেওয়া হয়েছিল। পাঁচ বছর পরে আইরিনকে তার প্রাসাদেই বন্দী করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় ক্যুয়ের মাধ্যমে। তাকেও এ দ্বীপে পাঠানো হয় এবং পরের বছর তিনি মারা যান, তার কবরও এ দ্বীপে।
এভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজা, রাজপুত্রদের দ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হতো। ১৮৯৮ সালের দিকে একজন ফ্রেঞ্চ অটোম্যান স্থপতি এখানে একটি বহুতল ভবন কাঠের হোটেল-ক্যাসিনো নির্মাণ করেন, নাম রাখেন প্রিঙ্কিপো প্যালেস। কিন্তু তখনকার সুলতান আব্দুল হামিদ এটি চালানোর পারমিট না দেওয়ায় তিনি বিক্রি করে দেন একজন গ্রীক ব্যাংকারের স্ত্রীর কাছে। যিনি এটি কিনে নেওয়ার পর একটি সংস্থাকে দান করেন। তারা এটিকে অনাথাশ্রম হিসাবে চালায়। পরে সাইপ্রাস ইস্যুর কারণে (গ্রীক আর তুর্কি সাইপ্রিয়টদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, অনেকটা ভারতীয় কাশ্মীর আর পাকিস্তানি কাশ্মীরের মতো) এ অনাথাশ্রম বন্ধ হয়ে যায়। এর খুব কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ভেতরে যাওয়ার কথা ভাবতেই দেখি আশ্রমটা বন্ধ।
হাজার বছরের পুরোনো চার্চ, পথ, বাড়ি দেখে ফেরার পথে ভিন্ন একটি পথে ফিরে আসি আমরা দ্বীপের বন্দরের কাছে। উঁচুতে চার্চের পাশেই খুব সুন্দর রেস্তোরাঁ ছিল। কিন্তু ওদের মেন্যুতে খুব বেশি আইটেম নেই। অগত্যা সেখানে বসে কফি খেতে খেতে চারিদিকের সুনসান নীরবতা উপভোগ করার সুযোগ হলো না। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে অট্টালিকাসম বিভিন্ন হোটেল আর সারি সারি সুন্দর সব রেস্তোরাঁ। ঘুরে ঘুরে এক পর্যায়ে বন্দরের পাশে আলী বাবা নামে একটি রেস্তোরাঁয় বসলাম। কাঠের জেটির মতো বানিয়ে তার ওপর বসার সুন্দর ব্যবস্থা, চারিদিকে কাঁচের দেয়াল দেয়া। যেন চারিদিকে দেখতে দেখতে খাওয়া যায় আর নিচে সমুদ্র।
যেহেতু ইস্তানবুলে ফিরে যাওয়ার জাহাজ ধরতে হবে। সুতরাং দ্রুত ভালো কিছু তুর্কি খাবারের অর্ডার দিলাম আমরা। খাওয়ার সময় আমার কন্যা হঠাৎ করে বলে উঠল, ‘মা মা! খেয়াল করেছ? বাবার নাম প্রিন্স আর আমরা প্রিন্সের দ্বীপে এসেছি এবং রেস্তোরাঁর নাম আলী বাবা। বাবার আরেকটা নাম আলী।’ সবই ঠিক! তবে দ্বীপটা আমার নিজের বলে দাবি করতে পারলাম না। সুতরাং ফিরতি জাহাজে চেপে ফিরে এলাম ইস্তানবুলে। এরপর ট্যাক্সি চেপে কনস্টানটিনোপলের গেটের কাছে যাই সুফিদের সেমা দেখার জন্য। এ ব্যাপারে আগামীতে আরেকটি আর্টিকেলে জানাবো। যারা তুর্কি কবি জালালুদ্দিন রুমি আর আধ্যাত্মিক ক্ষমতার সহচর শামস-তাব্রিজির কথা জানেন; তারা জানেন এটা কী?
Courtesy By-jagonews24
প্রাসঙ্গিক কথাঃ “ঢাকা বৃত্তান্ত”প্রচলিত অর্থে কোন সংবাদ মাধ্যম বা অনলাইন নিউজ সাইট নয়। এখানে প্রকাশিত কোন ফিচারের সাথে সংবাদ মাধ্যমের মিল খুঁজে পেলে সেটি শুধুই কাকতাল মাত্র। এখানে থাকা সকল তথ্য ফিচার কেন্দ্রীক ও ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত। “ঢাকায় থাকি”কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে এসব তথ্য একত্রিত করার ফলে তা ঢাকাবাসীকে সাহায্য করছে ও করবে। আসুন সবাই আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি। আমরা সবাই সচেতন, দায়িত্বশীল ও সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি।
৪০৬ বার পড়া হয়েছে