সিলেট শহর ছেড়ে মালনীছড়া চা–বাগানে প্রবেশ করার সময় চোখে পড়ে আকাশে মেঘের ঘনঘটা। ধূসর মেঘের দঙ্গল ক্রমেই দখল নিচ্ছে ঈশান কোণে। তা-ই দেখে মনের ভেতর এক মিশ্র অনুভূতির সংঘাত শুরু হলো। কারণ, ঝরনার প্রবল প্রবাহ দেখার জন্য বৃষ্টিময় দিনই চেয়েছিলাম। আবার ঝড়–তুফান হলে না জানি কী হয়!
আমরা যাচ্ছি পান্তুমাই ঝরনার মাধুর্যের টানে। সকালবেলা সিলেট নগরীর টিলাগড়ের বাসা থেকে বের হতে না হতেই ভ্রমণের আয়োজক রাফির ফোন। আম্বরখানায় পৌঁছে দলের সঙ্গে মিলিত হওয়ার পরই যাত্রার শুরু। চা–বাগানের মসৃণ সবুজ সাম্রাজ্য ছেড়ে আমরা তখন শালুটিকরে। সিলেটের উত্তর সীমান্ত লাগোয়া পাহাড়ি নদীর উত্তোলিত পাথরগুলোর বড় অংশ এখানে পৌঁছায়। আমাদের বাহন মোড় নিয়ে এবার ছোট রাস্তায় প্রবেশ করে। সে পথে যেতে যেতে একসময় বৃষ্টি নামে। তবে ততটা বেগ নেই বৃষ্টিতে। মেঘও ক্রমে সরে গিয়ে আকাশ অনেকটা পরিষ্কার।
চলন্ত গাড়ির জানালার কাচ সরিয়ে পথের দুই পাশ দেখতে থাকি। প্রায় এক দশক পর এ পথে আসা। প্রথমবার পথের দুই ধারে প্রচুর ঘাসবন আর নলখাগড়ার ঝোপ দেখেছিলাম। এবার বর্ষাকাল হওয়ায় তার বড় অংশই পানির নিচে, তাই দৃষ্টিগোচর হলো না। আমাদের আপাত গন্তব্য গোয়াইনঘাটের হাদারপার বাজার।
হাদারপার বাজারে পৌঁছালাম ভরদুপুরে। বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পিয়াইন নদ। নদের পাশ ঘেঁষে এক রেস্তোরাঁয় নাশতা সেরে সদলবল হাজির হয়ে যাই খেয়াঘাটে। এবার আমরা যাত্রী হব নৌপথে। ঘাটে নানান রঙের নৌকা ভেড়ানো। কিছুক্ষণ পরপর যাত্রী নিয়ে মাঝিরা ছুটছেন গন্তব্যে। দলের সবাই ঠিকঠাক নড়েচড়ে বসার পর মাঝি নোঙর তুললেন। স্রোতস্বিনী পিয়াইন, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়কোলে তার জন্ম। পাহাড়ের সন্তান হলেও চলতে চলতে যেন আপন করে নিয়েছে এই ভাটির দেশ। তাই তো তার বুকজুড়ে এত কর্মযজ্ঞ! রোদে পোড়া তামাটে চেহারা নিয়ে নদের বুকে শ্রমজীবী মানুষের অল্পে তুষ্ট হওয়ার হাসি দেখে সে–ও নিশ্চয়ই অস্ফুটে হাসে। নদের বুকে বেশ স্রোত তখন। উজান থেকে নেমে আসা প্রবল পাহাড়ি ঢলে বর্ষাকালে পিয়াইন থাকে এমন খরস্রোতা। যেতে যেতে চোখে পড়ে নদজুড়ে নানান ব্যস্ততা। যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছুটেছে মূল¯স্রোত ধরে। নদের পাড়ে মাছ ধরছে কিছু জেলেনৌকা। দু–একটি পাথরবাহী নৌকাও আমাদের পাশ কেটে চলে যাচ্ছে। এই নৌকার নাম বারকি নাও। সিলেটের খরস্রোতা পাহাড়ি নদ–নদীগুলোয় ঐতিহ্যবাহী এই বারকি নাওয়ের একচ্ছত্র দাপট। বিশেষত বালু–পাথর উত্তোলন আর পরিবহনের কাজে লাগে বারকি। লম্বাটে সরু গঠন হওয়ায় সহজেই প্রবল স্রোতেও চলতে পারে।
চলতে চলতে পিয়াইন এবার বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। তবে আমাদের গন্তব্য অন্য পথে হওয়ায় এবার পিয়াইনের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটাতে হলো। নৌকার গতিপথ বাঁক নিয়েছে ছোট একটা খাল ধরে। মাঝির কাছ থেকে জানলাম, এটি পিয়াইনের একটি শাখা নদী। স্থানীয়ভাবে পিয়াইন খাল নামে পরিচিত। খালটি ততটা গভীর নয়। আর তাই নৌকা চলছিল ধীরে, দেখেশুনে। তারপরও হঠাৎ হঠাৎ নৌকার তলা নদীর ডুবোতলে আটকে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে দলের চঞ্চল দুই সদস্য কৃষ্ণ আর নাইম ছিলেন বেশ তৎপর। পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঠেলে নৌকার চলাচল স্বাভাবিক রাখছেন। খালের অগভীর পানি একদম স্ফটিকস্বচ্ছ। টলটলে এই পানির উৎস উজানে পান্তুমাই ঝরনা। তলদেশের বালু, খনিজ পাথরে সূর্যালোক প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে। খালের এক পাশ ধরে অনতিদূরে চলে গেছে মেঘালয় পাহাড়শ্রেণি। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে! অন্য পাশের ভূমিরূপ টিলাময়। সুপারি, আনারস, লেবু ইত্যাদি ফল-ফসলের প্রাচুর্য চোখে পড়ে। পাড়ের সবুজ ও মসৃণ জমিতে চরছে ভেড়ার পাল। বাঁশের ঝুড়িতে করে এক শ্রমজীবীকে কিছু একটা পরিষ্কার করতে দেখে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওটাতে কয়লার টুকরা। স্রোতের তলদেশ থেকে উত্তোলিত এসব কয়লা ভেসে এসেছে ঝরনার জলে। দূর থেকেই ঝরনার পতনের শব্দ কানে আসছিল। তারপর বাঁক পেরোতেই দূর থেকে চোখে ধরা দেয় পান্তুমাইয়ের মোহনীয় রূপ।
ফিচার বিজ্ঞাপন
জাপান ভিসা প্রসেসিং (বিজনেসম্যান)
Domain Registration
চল্লিশ ফিট রোডের সাথে ৫ কাঠা প্লট কিনুন ।
মাঝি খালের এক পাশে নৌকা নোঙর করলেন। সুনসান পড়ন্ত দুপুর। মুগ্ধ করা সবুজের দৃশ্যপটে চারপাশজুড়ে অবাক নীরবতা। সেই নীরবতা ভেঙে দূর থেকে কানে মোলায়েম পরশে ঝংকার তুলছে ঝরনার ঝরঝর শব্দ। মেঘালয় পাহাড়জুড়ে ঘন কালচে সবুজ অরণ্য। অরণ্যের ঠাসবুনোটের ভেতর দিয়ে শৈলশ্রেণির বুক বেয়ে নেমে এসেছে পান্তুমাই ঝরনার ধবধবে সাদা প্রবাহ। রাত আর সকালে বৃষ্টি হওয়ায় প্রবল গর্জনে পান্তুমাই ফুঁসছে যেন। পান্তুমাই নামের ছবির মতো সুন্দর এক সীমান্ত গ্রাম, মেঘালয় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে যার অবস্থান। পর্যটকদের কারও কারও চোখে যেটি দেশের সুন্দরতম গ্রামগুলোর একটি। আর সেই গ্রামের নামেই পান্তুমাই ঝরনার নামকরণ। সীমান্তের ওপাশে যার নাম বরহিল ফলস। মেঘালয়ের ইস্ট খাসি হিলস জেলায় পড়েছে ঝরনার উৎপত্তিস্থল।
কাপড় বদল করে এবার নেমে পড়ি পাহাড়ি নদীর স্রোতে। শরীরে পানির ছোঁয়া লাগতেই হিমশীতল স্পর্শে পুলকিত হলাম। শৈলশ্রেণি, নুড়ি পাথর আর অরণ্যের গহীনতল ছুঁয়ে আসা জলধারা তো এমন শীতল হবেই! পাহাড়ি নদীর ভরা স্রোত যেন কৈশোরে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। দল বেঁধে সাঁতার কাটলাম। ডুব দিলাম পানির একদম তলদেশে। শ্বাস আটকে প্রাণ ভরে দেখি নদীর তলদেশের প্রাণবৈচিত্র্য। কাদা আর সাদা বালুর ওপর জন্মেছে শেওলা আর জলজ উদ্ভিদ। ছোট ছোট মাছ সাঁতরে লুকাচ্ছে জলতলের সেই বনে। আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতরাচ্ছে রাজহাঁসের দল। কণ্ঠে তাদের বিচিত্র শব্দ। নদীর পাড়ে লতাগুল্ম অর্কিডের আঁটসাঁট বুনোটে বাঁধা পড়া বয়সী বৃক্ষ। সহচর হয়ে পাশে আদ্যিকালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেঘালয় পাহাড়। মনে পড়ে যায় জীবনানন্দ দাশের কালজয়ী কবিতার কয়েকটি পঙ্ক্তি—‘পৃথিবী প্রবীণ আরও হয়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে/…পৃথিবীর রাঁজহাস নয়, নিবিড় নক্ষত্র থেকে যেন সমাগত সন্ধ্যার নদীর জলে এক ভিড় হাঁস অই-একা।’
নিজেকে জিজ্ঞেস করি, জীবনানন্দও কি দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রাচীন পৃথিবীর যোগসূত্রের এমন কোনো দৃশ্যপটে? নৌকার ভেতর থেকে রাফির ডাকে খেয়াল হয়, এতক্ষণে পেট চোঁ চোঁ করছে। ফেরার পথে দিনের আলো ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে এল। বিকেলের নীরবতা ভেঙে ইঞ্জিনচালিত নৌকার ঢেউ চাঞ্চল্য তুলছে স্রোতে। সেই শব্দে হকচকিত হয়ে ঘাসবন থেকে উড়ে পালায় একঝাঁক মুনিয়া। মেঘালয় পাহাড় ঝাপসা কালচে চেহারায় ক্রমেই হারাচ্ছে দূরে। আর আমরাও যেন জীবনানন্দের মিরুজিন নদী ধরে ছুটে চলি ঘরে ফেরার অভিপ্রায়ে। পেছনে পড়ে থাকে পান্তুমাইয়ের মাতাল করা সুরের মূর্ছনা।
প্রাসঙ্গিক কথাঃ “ঢাকা বৃত্তান্ত”প্রচলিত অর্থে কোন সংবাদ মাধ্যম বা অনলাইন নিউজ সাইট নয়। এখানে প্রকাশিত কোন ফিচারের সাথে সংবাদ মাধ্যমের মিল খুঁজে পেলে সেটি শুধুই কাকতাল মাত্র। এখানে থাকা সকল তথ্য ফিচার কেন্দ্রীক ও ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত। “ঢাকায় থাকি”কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে এসব তথ্য একত্রিত করার ফলে তা ঢাকাবাসীকে সাহায্য করছে ও করবে। আসুন সবাই আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি। আমরা সবাই সচেতন, দায়িত্বশীল ও সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি।
১৭৫ বার পড়া হয়েছে