‘মুখের মদ্যি দুডো পান না দিলি শান্তি লাগে না।’

যাত্রা শুরুর ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে তৃতীয়বার একই কথা বললেন সুলতান মালি। ট্রলারের পেছনের অংশে মাটির চুলায় হাঁড়ি তুলে দিয়েছেন তিনি। হাঁসের মাংস রান্না করছেন বলে উনুনে বাড়তি নজর। পাশে বসে জিজ্ঞেস করি, ‘রান্নার কাজ করছেন কত দিন?’

মৌলিক প্রশ্নটা আরও আগেই করা উচিত ছিল। কিন্তু গত তিন দিনে করা হয়নি। বোটম্যান, জেলে, বন বিভাগের কর্মীসহ ট্রলারে আমরা ১৪ জন, তিন দিন ধরে এই জলযানই আমাদের ঠিকানা। সেটা গত ডিসেম্বরের কথা। জলে ভাসতে ভাসতে নানা বিষয়ে আলাপ হয়েছে, সেই আলাপে তিনিও শরিক হয়েছেন। কিন্তু অনাবিষ্কৃত থেকে গেছেন ব্যক্তি সুলতান মালি।

জ্বলন্ত লাকড়ি চুলার ভেতরে ঠেলে দিয়ে সুলতান মালি বললেন, ‘এ কাজ এখন আমি করিনে। বছরভর জঙ্গল করি’। বাক্য শেষ হতেই হাসলেন। রান্নার প্রশংসা করে অবশ্য তিন দিনে তাঁর এমন প্রশান্তিময় হাসির দেখা মিলেছে আরও কয়েকবার!

সুলতান মালির ‘জঙ্গল করি’ শব্দের অর্থ তিনি বনজীবী। সুন্দরবনে মাছ শিকার করেন। তিন দিন ট্রলারে সুন্দরবনে ভেসে ভেসে এমন দু-একটা শব্দের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছে। তার মধ্যে ‘জঙ্গল করি’ শব্দটা একবারে ব্যতিক্রম। সুলতান মালি একসময় রান্নার কাজই করতেন। কাছের মানুষেরা রান্নার কাজটা ভালোভাবে দেখে না বলে ছেড়ে দিয়েছেন। এখন বিশেষ তলব পড়লে দিন কয়েকের জন্য ট্রলারে থাকেন। সে–ও সুন্দরবনেই। অর্থাৎ, জঙ্গলই তাঁর জীবিকা।

বনের ভেতর এমন আরও অনেক বনজীবীর দেখা মিলেছে। বনের অভয়াশ্রমঘোষিত এলাকা ছেড়ে আমরা গিয়েছিলাম দূরের খালে মাছ ধরতে, সেখানেও জেলের কাছে শুনেছি প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচার গল্প, পরিবার-পরিজন ছেড়ে দিনের পর দিন গহিন বনে থাকার কথা আর তাঁদের দেখা ভিন্ন সুন্দরবনের কাহিনি।

সেসব লোককাহিনি পুঁজি করেই সেদিন আমরা ফিরতি যাত্রা করেছিলাম সুন্দরবনের নীলকমল থেকে (বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে এটি হিরণ পয়েন্ট হিসেবে পরিচিত)। বন বিভাগের ক্যাম্প আছে সেখানে। ইউনেসকো যে সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করেছে, সেই ফলকটাও এই নীলকমলে। তারই পেছনে বন বিভাগের উদ্যোগে তৈরি হয়েছে রেস্ট হাউস। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বনে বনে ঘুরলেও, রাতে থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল এই রেস্ট হাউসে।

সুলতান মালির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই সকালের সূর্য চোখ মেলেছে। কুয়াশার আস্তরণ কেটে গিয়েছে ধীরে ধীরে। তবে উত্তুরে হাওয়ায় যে কনকনে শীত, তা হাড় কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। সকালের সোনা রোদ গায়ে মেখে ট্রলারের ছাদে বসে সুন্দরবন দেখার ইচ্ছেটা তাই স্থগিত করতে হলো। কেবিনের চৌকিমতো বিছানায় শুয়ে কবাট খুলে দিলাম। ১৪ ইঞ্চি টেলিভিশনের পর্দার মতো ছোট্ট জানালায় ফুটে উঠল খালের পাড়, আর তার ওপর বৃক্ষরাজি। গরান, গেওয়া আর গোলপাতার যৌথ বসবাস। কখনো এজমালি বসবাস, কখনো স্বতন্ত্র এলাকায় নিজেদের রাজত্ব। কেওড়াবনে মিলল প্রাতর্ভোজনে বের হওয়া হরিণের দেখা। যাদের একাকী ভোজনে রোচে না, তারা পাতা ছিঁড়ছিল দলগতভাবে। প্রতিবেশীদের মধ্যে নিজেকে বড় জানান দিতে কেওড়াগাছ ডালপালা ওপরে তুলে নিয়েছে, ঠিক সে গাছে একটা হরিণকে দেখলাম দুই পা তুলে পাতা ছিঁড়তে। হরিণের সঙ্গে নাকি বানরের নিবিড় বন্ধুত্ব। সুন্দরবনে যাঁদের জীবিকা, তাঁরা বলেন, বানর হলো হরিণের অকৃত্রিম বন্ধু। বাঘের আনাগোনা দেখলে বানরই সতর্ক করে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। কখনো কখনো কেওড়াগাছের ডাল ভেঙে দেয় হরিণকুলের খাবারের জন্য।

ফিচার বিজ্ঞাপন

USA Visa (for Businessman)

মূল্য: 5,000 Taka

Singapore Tour with Sentosa 4D/3N

মূল্য: ২৪,৯০০ টাকা

নীলকমল থেকে অনেকটা দূরে চলে আসি আমরা। সকালের খাবারের খোঁজে তখন অনেকেই খালপাড়ে, পাড়ঘেঁষা বনে। তাদের মধ্যে দেখা গেল বক, মাছরাঙা, শূকর, নাম না জানা আর কিছু পাখি। মগডালে দেখা মিলল মদনটাকের। বেশ আয়েশ করে রোদ পোহাচ্ছিল। আগের দিন দুপুরে এদিকে ঘুরতে এসে দেখা মিলেছিল বড়সড় কুমিরের। তখন বেশ আয়েশ করে রোদ পোহাচ্ছিল সে। আনমনে তাকেও যেন খুঁজলাম!

সহযাত্রীদের অনেকেই তখন আড়মোড়া ভাঙতে শুরু করেছেন। ট্রলারের আটপৌরে কেবিন থেকে বেরিয়েই ‘ও হো কী শীত রে বাবা’ বলে শান্ত কুমার মণ্ডল ত্রস্ত হয়ে আবার ভেতরে ঢুকলেন। ভাবখানা এমন যেন, তিন দিনে অনেক বন দেখা হয়েছে, শেষবেলায় কম্বল মুড়ি দিয়ে বসে থাকাই শ্রেয়। তবে ক্যামেরা হাতে দলের দুই সদস্য শেখ আল-এহসান ও মেহেদী হাসান ধারণ করতে চাইলেন সকালের সুন্দরবন। কিন্তু লেন্সের জোর এতই কম যে দূরের হরিণকে গাছ বলে বোধ হচ্ছিল! হতাশ হয়ে তাঁরা গোলপাতার ছবি তুলতে শুরু করলেন!

খাল পেরিয়ে চলে আসি হংসরাজ নদে। নদের প্রশস্ততা বড় হতে থাকে। এক পাশের বন ধরে আমরা এগিয়ে যাই। দু-একটি জেলে নৌকা কদাচিৎ দেখা মেলে। আমরা থেমে জেলেদের কুশল জিজ্ঞেস করি। স্বচ্ছ জলে দিন কয়েক হলো মাছ বেশ খেলছে জালের সঙ্গে, জানান তাঁরা। তারপর দীর্ঘ সময় আর কোনো জনমানুষের দেখা নেই। দুপাশজুড়ে শুধুই বন তখন।

হংসরাজকে বিদায় জানিয়ে ট্রলার প্রবেশ করে আলকি নদে। তারপর কে যেন বলে উঠল, সামনেই শিবসা। শিবসা যে হংসরাজের চেয়ে বড় নদী, তার প্রমাণ দিচ্ছিল ঢেউ। ঢেউয়ের তালে দোল খাচ্ছিল ট্রলার। এক পাশের বন আরও দূরে চলে যেতে থাকল, কোথাও কোথাও সফেদ কুয়াশায় বিবর্ণ মনে হলো সবুজবীথি। ঠিক তখনই কারও কারও মুঠোফোনে মুহুর্মুহু খুদে বার্তা আসতে শুরু করল। বনের ভেতর টেলিটক ছাড়া অন্য কোনো মোবাইল সংযোগদাতা প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, তাই খুদে বার্তার টুং-টাং শব্দ জানান দিল লোকালয় আসন্ন।

সেই লোকালয় দৃশ্যমান হলো ঘণ্টাখানেক পর। আমরা তখন খুলনার পাইকগাছায়। জেটিতে ট্রলার ভিড়তে একে একে নেমে পড়লাম সবাই। ট্রলারে শুধু থাকলেন সুলতান মালি আর বোটম্যান মাহফুজ রহমান। সুলতান মালি তাঁর সহজাত হাসি মুখে ধরে রেখে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন। তাঁদের গন্তব্য কয়রার কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন। ১৬ ডিসেম্বর সেখান থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

প্রাসঙ্গিক কথাঃ “ঢাকা বৃত্তান্ত”প্রচলিত অর্থে কোন সংবাদ মাধ্যম বা অনলাইন নিউজ সাইট নয়। এখানে প্রকাশিত কোন ফিচারের সাথে সংবাদ মাধ্যমের মিল খুঁজে পেলে সেটি শুধুই কাকতাল মাত্র। এখানে থাকা সকল তথ্য ফিচার কেন্দ্রীক ও ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত। “ঢাকায় থাকি”কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে এসব তথ্য একত্রিত করার ফলে তা ঢাকাবাসীকে সাহায্য করছে ও করবে। আসুন সবাই আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি। আমরা সবাই সচেতন, দায়িত্বশীল ও সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি।



৫১৬ বার পড়া হয়েছে