করোনাভাইরাসের আঘাতে টালমাটাল সারা বিশ্ব। এ লেখা যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে করোনাভাইরাসে প্রায় ১৫ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে এবং এর মধ্যে মারা গেছে প্রায় সাড়ে ৩১ লাখ মানুষ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই মৃত্যু হয়েছে ৫ লাখ ৮৮ হাজার মানুষের।

এর পরে রয়েছে ব্রাজিল, মেক্সিকো, ভারত, যুক্তরাজ্য, ইতালি, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন এবং অন্যান্য দেশ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট মৃত্যুর তিন ভাগের দুই ভাগের মৃত্যু হয়েছে এই দশটি দেশে, যার মধ্যে ব্রাজিল, মেক্সিকো ও ভারত বাদে সব দেশ উন্নত।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলো করোনায় যেমন বিপর্যস্ত, তেমনি করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও প্রয়োগেও তারা এগিয়ে। করোনাভাইরাস শনাক্তের মাত্র চার মাসের মাথায় এসব দেশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করে এবং বেশ ভালো ফলও পায়। যুক্তরাজ্য বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে গত বছরের ডিসেম্বরে জনসাধারণের ওপর টিকা প্রয়োগের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী সারা বিশ্বে সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত ১৩টি ভ্যাকসিন জনসাধারণের ওপর প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, যুক্তরাজ্য ও সুইডেনের অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ফাইজার-বায়োএনটেক, রাশিয়ার স্পুটনিক ভি, যুক্তরাষ্ট্র ও নেদারল্যান্ডসের জনসন অ্যান্ড জনসন, চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকসের অ্যাড৫-এন-কোভ, সিনোভ্যাক কোম্পানির করোনাভ্যাক ও সিনোফার্ম কোম্পানির বিবিআইপি-করভি এবং ভারতীয় কোম্পানি ভারত বায়োটেকের কোভ্যাকসিন বা বিবিভি ১৫২।

এছাড়াও বিভিন্ন দেশের আরও ৭০টি টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলমান। গত ২৫ এপ্রিল বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেকের বঙ্গভ্যাক্স ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি পেয়েছে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশে ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে যুক্তরাজ্য ও সুইডেন আবিষ্কৃত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রজেনেকার টিকা দেওয়া হচ্ছে। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট কর্তৃক প্রস্তুতকৃত এ ভ্যাকসিনটির প্রথম ডোজ নিয়েছেন ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৫৮ লাখ মানুষ এবং দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন প্রায় সাড়ে ২১ লাখ মানুষ। কিন্তু ভারত করোনাভাইরাসের টিকা রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচিতে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়।

সংকট কাটাতে ২৬ এপ্রিল থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রথম ডোজ টিকা প্রদান সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। সবার জন্য ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে সরকার তাই বাধ্য হয়ে ভ্যাকসিনের বিকল্প উৎস খুঁজছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বরাত দিয়ে বিভিন্ন মিডিয়া বলছে, রাশিয়া তাদের স্পুটনিক ভি টিকা বাংলাদেশে তৈরির ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

প্রস্তাব অনুযায়ী রাশিয়া প্রযুক্তিগত সহায়তা দেবে আর বাংলাদেশি ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো স্পুটনিক ভি টিকা উৎপাদন করবে। এটা নিঃসন্দেহে একটা সুখবর। প্রসঙ্গত, দেশের কমপক্ষে তিনটি কোম্পানির টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। কোম্পানিগুলো হলো ইনসেপটা লিমিটেড, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালস ও হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস।

প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে এ কোম্পানিগুলো দুই-তিন মাসের মধ্যেই টিকা উৎপাদনে যেতে পারবে বলে জানিয়েছে। এদিকে ২৭ এপ্রিল ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর বাংলাদেশে স্পুটনিক ভি টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে। এতে করে এই টিকা আমদানি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে এখন আর কোনো আইনগত বাধা থাকল না।

প্রশ্ন হলো, স্পুটনিক ভি টিকা কতটা নিরাপদ ও কার্যকর? অন্যান্য টিকা যেমন: অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, মডার্না, ফাইজার-বায়োএনটেক ইত্যাদির তুলনায় এর কার্যকারিতা কেমন? এসব বিষয় আমাদের দেশের গণমাধ্যমে খুব একটা প্রচার পায়নি। তাই এ নিয়েই আলোচনা করব এই লেখায়।

স্পুটনিক ভি টিকাটি আবিষ্কার করেছে রাশিয়ার গ্যামেলিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলোজি ও মাইক্রোবায়োলজি নামক একটি প্রতিষ্ঠান। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকসের অ্যাড৫-এন-কোভের মতো এ ভ্যাকসিনটি এক ধরনের ভেক্টর ভ্যাকসিন। এতে অনুলিপি তৈরি করতে সক্ষম নয় এরকম রিকম্বিনেন্ট অ্যাডিনোভাইরাসকে ভেক্টর হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।

অ্যাডিনোভাইরাসকে ব্যবহার করে এর আগেও অন্যান্য রোগের জন্য ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়েছে এবং নিরাপদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। জেনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টরের মধ্যে করোনাভাইরাসের সার্স-কোভ-২ প্রজাতিটির পূর্ণ দৈর্ঘ্যরে স্পাইক প্রোটিন জিনটি প্রবেশ করিয়ে বানানো হয়েছে স্পুটনিক ভি টিকাটি। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকসের অ্যাড৫-এন-কোভ কাছাকাছি প্রযুক্তিতে তৈরি।

যেমন অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা ব্যবহার করেছে শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাস, জনসন অ্যান্ড জনসন ব্যবহার করেছে অ্যাডিনোভাইরাস টাইপ ২৬, চীনের ক্যানসিনো বায়োলজিকস ব্যবহার করেছে অ্যাডিনোভাইরাস টাইপ ৫। ভিন্ন ভিন্ন অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ব্যবহার করা হলেও স্পুটনিক ভিসহ এ চারটি ভ্যাকসিনেই ব্যবহার করা হয়েছে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জিন।

ফিচার বিজ্ঞাপন

যমুনা রিসোর্ট প্রাইভেট ডে লং ট্যুর

মূল্য: ১৫০০ টাকা জনপ্রতি

Ho chi minh -Hanoi – Halong Cruise 5D/4N

মূল্য: 49,900 Taka

USA Visa (Private Job Holder)

মূল্য: 5,000 Taka

উল্লিখিত তিনটি সমগোত্রীয় ভ্যাকসিনের সঙ্গে স্পুটনিক ভি-এর পার্থক্য হল, এর প্রথম ডোজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে রিকম্বিনেন্ট অ্যাডিনোভাইরাস টাইপ ২৬ এবং দ্বিতীয় ডোজে ব্যবহার করা হয়েছে রিকম্বিনেন্ট অ্যাডিনোভাইরাস টাইপ ৫ ভেক্টর। দুই ডোজের ব্যবধান ২১ দিন।

গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রভাবশালী মেডিকেল জার্নাল ল্যানসেটে স্পুটনিক ভি টিকার তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে (Safety and efficacy of an rAd26 and rAd5 vector-based heterologous prime-boost COVID-19 vaccine: an interim analysis of a randomised controlled phase 3 trial in Russia. Lancet, 2 February2021)। সাধারণত তৃতীয় ধাপের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য রেগুলেটরি অথরিটি টিকা বা অন্য যে কোনো পরীক্ষাধীন ওষুধ ব্যবহারের প্রাথমিক অনুমোদন দিয়ে থাকে।

কিন্তু অজানা কারণে স্পুটনিক ভি টিকার তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল ল্যানসেটের মতো প্রভাবশালী জার্নালে প্রকাশিত হলেও পাশ্চাত্য মিডিয়া এবং আমাদের দেশীয় গণমাধ্যমে তেমন প্রচার পায়নি। রাশিয়ার বিভিন্ন হাসপাতালে ১৮ বছরের বেশি ২১ হাজার ৯৭৭ ব্যক্তির ওপর পরিচালিত একটি গবেষণার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে ল্যানসেটের ওই গবেষণাপত্রটিতে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-র‌্যানডমাইজড, ডাবল ব্লাইন্ড পদ্ধতিতে ট্রায়ালে অংশগ্রহণকারীদের ভ্যাকসিন এবং প্লাসেবো এ দুই গ্রুপে ৩:১ অনুপাতে ভাগ করা হয়।

এর মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রুপের ১৬ হাজার ৫০১ জনকে স্পুটনিক ভি এবং ৫ হাজার ৪৭৬ জনকে প্লাসিবো (ভ্যাকসিনের মতো দেখতে অন্য কিছু) দেওয়া হয়। ২১ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার দিন রোগীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় এবং পিসিআর টেস্টের মাধ্যমে কোভিড-১৯ টেস্ট করা হয়।

পিসিআর টেস্টের ফলাফলে দেখা যায় ভ্যাকসিন গ্রুপের ১৪ হাজার ৯৬৪ জনের মধ্যে ১৬ জনের কোভিড-১৯ ধরা পড়েছে, যা শতকরা হিসাবে ০.১ শতাংশ। অন্যদিকে প্লাসিবো গ্রুপের ৪ হাজার ৯০২ জনের মধ্যে ৬২ জনের কোভিড-১৯ ধরা পড়ে, যা শতকরা হিসাবে ১.৩ শতাংশ। তার মানে, স্পুটনিক ভি টিকার কার্যকারিতা ৯১.৬ শতাংশ, যা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা থেকে ১৫.৬ শতাংশ বেশি।

ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বলছে, স্পুটনিক ভি সাধারণভাবে নিরাপদ, তবে অন্যান্য টিকার মতো স্পুটনিক ভি টিকারও সাধারণ কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। এর মধ্যে ছিল ফ্লুর মতো উপসর্গ (জ্বর, গা ব্যথা), ইঞ্জেকশনের স্থলে লাল হয়ে যাওয়া, মাথাব্যথা ও শারীরিক দুর্বলতা। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ভ্যাকসিন গ্রুপের মধ্য থেকে তিনজন এবং প্লাসিবো গ্রুপের একজন মারা যায় এবং গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, এসব মৃত্যুর সঙ্গে ভ্যাকসিন গ্রহণের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

স্পুটনিক ভি টিকার সংরক্ষণ পদ্ধতিও কিছুটা সহজ। বিজ্ঞানীরা এর দুটি ফর্মুলেশন বের করেছেন। একটি তরল এবং অন্যটি শুষ্ক (ফ্রিজ-ড্রাইড)। তরল ফর্মুলেশনটি মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় (বাসায় ব্যবহারের ফ্রিজের ফ্রিজার অংশের তাপমাত্রা) সংরক্ষণ করতে হবে এবং ফ্রিজ-ড্রাইড ফর্মুলেশনটি ২-৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যাবে। তাই ফ্রিজ-ড্রাইড ফর্মুলেশনটি আমদানি-রপ্তানি উপযোগী।

স্পুটনিক ভি-এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল বেশ আশাব্যঞ্জক। ভ্যাকসিন নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকার কর্তৃক এ টিকা ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাই। আমদানির পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে প্রস্তুত করার যে প্রস্তাব রাশিয়া দিয়েছে সেটাকে কাজে লাগাতে হবে। এতে আমাদের ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা পুনরায় অর্জিত হবে।

প্রসঙ্গত, মহাখালীতে অবস্থিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একসময় ছয় ধরনের টিকা উৎপাদন করত এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানিও করত। প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে ২০১১ সালে তাদের টিকা উৎপাদন একবারে বন্ধ হয়ে যায়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের টিকা উৎপাদনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে এবং গ্লোবের মতো দেশীয় কোম্পানিগুলোকে প্রণোদনা দিয়ে আমাদের স্থানীয়ভাবে টিকা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। আর তাহলে অন্য অনেক ওষুধের মতো দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে আমরাও আমাদের তৈরি ভ্যাকসিন রপ্তানি করতে সক্ষম হব।

ড. মো. আজিজুর রহমান : সহযোগী অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

প্রাসঙ্গিক কথাঃ “ঢাকা বৃত্তান্ত”প্রচলিত অর্থে কোন সংবাদ মাধ্যম বা অনলাইন নিউজ সাইট নয়। এখানে প্রকাশিত কোন ফিচারের সাথে সংবাদ মাধ্যমের মিল খুঁজে পেলে সেটি শুধুই কাকতাল মাত্র। এখানে থাকা সকল তথ্য ফিচার কেন্দ্রীক ও ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত। “ঢাকায় থাকি”কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে এসব তথ্য একত্রিত করার ফলে তা ঢাকাবাসীকে সাহায্য করছে ও করবে। আসুন সবাই আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি। আমরা সবাই সচেতন, দায়িত্বশীল ও সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি।

কুইক সেল অফার

Online Shopping BD (Facebook Live)



৩৭৭ বার পড়া হয়েছে