এমভি পানামা আমাদের যখন তমরশুদ্দি লঞ্চঘাটে নামিয়ে দিল, তখনো পুরো এলাকা কুয়াশার চাদরে ঢাকা। নেমেই স্কুটারের খোঁজে হাঁটা শুরু করলাম। দর কষাকষি করে পাঁচশ পঞ্চাশ টাকায় পেয়েও গেলাম একটি। যাব হাতিয়ার জাহাজমারা হয়ে বন্দরটিলা ঘাট। পিচ ঢালা পথে কিছু দূর যাবার পর পথ ক্রমশই দুর্গম হতে লাগল। কোথাও ইট বিছানো রাস্তা, কোথাও আবার তাও নেই। এরই মধ্যে ঘন্টা তিনেক পার করে অবশেষে আমরা পৌঁছালাম ঘাটে। পথে ছোট একটি দুর্ঘটনাও ঘটে গেল। বেড়িবাঁধের উপরে উঠতে গিয়ে আমাদের স্কুটারটি উল্টে গিয়ে পড়ল একেবারে কিশোরের উপরে। মুহূর্তেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল ও। কিশোরের অবস্থা দেখে ভ্রমণ কর্মসূচী বাদ দিয়ে ঢাকায় ফিরে যাবার চিন্তা করলাম। স্থানীয় এক গ্রাম্য ডাক্তারের প্রাথমিক চিকিৎসায় জ্ঞান ফিরে পেল কিশোর। বললাম চলো ঢাকায় ফিরে যাই। ও বলল ফিরে যাই মানে? আমি ঠিক আছি। সামান্য পায়ে আঘাত লেগেছে। ওই স্কুটার নিয়েই আমরা চললাম চ্যানেল ঘাটের দিকে। ঘাটে লোক বোঝাই পারাপার ট্রলারটি যেন আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল। আমরা ওঠামাত্রই ছেড়ে দিল ওপারের উদ্দেশ্যে। এই চ্যানেলটির ওপারেই নিঝুম দ্বীপ। দ্বীপের যে প্রান্তে আমরা নামব তারই নাম বন্দর টিলা। সাত টাকা ভাড়ায় ট্রলারে এ চ্যানেল পার হতে লাগল মিনিট পনের।

আমরা দ্বীপের যে প্রান্তে নেমেছি ঠিক তার বিপরীত দিকটাতে নামা বাজার। নিঝুম দ্বীপের সবচেয়ে বড় বাজার। আমাদের থাকার জায়গাটা ওখানেই। অবকাশ পর্যটনের রিজর্ট নিঝুম। দ্বীপের একমাত্র মান সম্পন্ন থাকার জায়গা।

বন্দরটিলা থেকে নামা বাজার প্রায় দশ কিলোমিটারের দূরত্ব। দ্বীপের প্রধান সড়কটি কাঁচা। এখন শুকনো বলে কিছু রিকশা চলে এ পথে। আমাদের দেখে রিকশাওয়ালাদের চিনতে বাকি রইলনা। এসেছি ভ্রমণে। আশি টাকার ভাড়া তাই দুশো টাকা হাঁকিয়ে বসল ওদের নেতা গোছের একজন। খুব শক্ত সিন্ডিকেট। এর কমে কেউই প্যাডেলে পা মারবে না। আমরাও কম নই। কিশোর বলল চলো রিকশায় যাবই না, ছবি তুলতে তুলতে হেঁটে হেঁটে চলে যাই। আমরা হাঁটা শুরশু করতেই দু’রিকশা চালক পিছু পিছু এসে বলল স্যার একটু কমিয়ে দিয়েন। আপনাদের নিয়ে যাই। শেষ পর্যন্ত তিনশ টাকায় দু’রিকশা নিয়ে আমরা চললাম নামা বাজারের দিকে।

রিকশা আমাদের একেবারে রিজর্টের দুয়ারে এসে নামিয়ে দিল। রিজর্টের কেয়ার টেকার যেন আমাদের অপেক্ষাতেই ছিলেন। আমাদের ঘরটা আগে থেকেই তৈরি করা ছিল। ছিমছাম ছোট্ট দ্বিতল রিজর্ট। একেবারে তকতকে বিছানা। পরিস্কার বাথরুম। এরকম একটি জায়গায় এটি ছিল আমার কল্পনাতীত।

দুপুরের খাবারটা সেরে আমরা বেড়িয়ে পরলাম। দিনের বাকি সময়টা নদীর ধারে ঘুরে কাটাব বলে বের হলাম। নানা রকম পাখি দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম একেবারে জঙ্গলের কাছে। ছোট্ট একটি খাল পেরুলেই ওপাড়ে ঘন বন। চিত্রা হরিণের অভয়ারণ্য।

নৌকার জন্য খালের পারে অপেক্ষায় ছিলাম। হঠাৎ করে আসা একটি জেলে নৌকায় পার হয়ে বনে ঢুকতে ঢুকতে সূর্য তখন অস্তাচল মূখী। দূরে হরিণের দল চোখে পড়ল। এতো দূর থেকেও আমাদের আগমন টের পেয়ে একে একে সটকে পড়ছিল বনের গভীরে।

রাতে রিজর্টের কেয়ারটেকার বরিশালের বাকেরগঞ্জের মনির সর্দার আমাদের পরবর্তী দিনের ভ্রমণসূচী ঠিক করে দিলেন। দীর্ঘ ছয় বছর ধরে এখানে থাকেন বলে দ্বীপের জায়গাগুলো তার নখদর্পনে। এখানে বেড়াতে আসা অতিথিদের দীর্ঘ দিন ধরে সেবা করে আসছেন সহজ সরল এ মানুষটি।

পরদিন খুব ভোরে আমরা হাঁটা শুরু করলাম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। মনির ভাই সবচেয়ে বিশ্বস্ত গাইড কামাল মিয়াকে দিলেন আমাদের সঙ্গে। কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে আমরা হাঁটছি গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে। গ্রামের পরিবারগুলো কেবল জেগে উঠতে শুরু করেছে। হাঁটতে হাঁটতে পূবাকাশের কুয়াশা ভেঙ্গে সূর্য উঁকি দিল। দেখতে দেখতে আমরা ঢুকে পড়লাম গভীর বনে। আমাদের দেখে দূরে বনের মধ্যে উৎসুক দৃষ্টিতে উঁকি ঝুকি মারছিল চতুর হরিণের দল। কিছু দূর হাঁটতে হাঁটতে কুকুরের চেঁচামেচি শুনে কামাল ভাই বললেন কুকুর হরিণ ধরছে। আমরা কুকুরের শব্দের উৎসের দিকে ছুটলাম। কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই সামনে পড়ল মর্মান্তিক দৃশ্য। হিংস্র কুকুরেরা বিশাল একটি হরিণ খাচ্ছে। গায়ের রক্ত দেখে মনে হলো এই মাত্রই মারা পড়েছে হরিণটি। নিঝুম দ্বীপের প্রধান এই জীব বৈচিত্রটির সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এখন এসব কুকুর।

সকালের জঙ্গল ভ্রমণ শেষ করে এসে দেখি আমাদের জন্য ট্রলার রেডি। হরিণের দল দেখতে আমরা যাব চৌধুরী খালের শেষ মাথায়। মনির ভাই বললেন, ওই দিকটায় হরিণ বেশি দেখা যায়। ঘন্টা খানেক পরে আমাদের নিয়ে ট্রলার পৌঁছল একেবারে জঙ্গলের ভেতরে। হাঁটু কাদা ভেঙ্গে আমরা ট্রলার থেকে নেমে পড়লাম। সঙ্গে দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছি। সারাদিনই এ জায়গাাটাতে কাটাব। বনের এক পাশে নিজেদের আড়াল করে নিঃশব্দে বসে রইলাম। ঘন্টা খানেক চুপ চাপ বসে থাকার পরে দূরে একটি দুটি করে বের হতে শুরু করলো

চিত্রা হরিণের পাল। আমাদের বসার জায়গাটি খুব ভালো হয়নি বলে এবারে প্রচুর হরিণ দেখলেও ছবি তুলতে পারছিলাম না গাছের বাঁধার কারণে। আসাদ বলল এবার জায়গাটি পারিবর্তন করতে হবে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলাম মজার একটি লোকেশন। আবারও নিজেদের যথাসাধ্য আড়াল করার চেষ্টা। চুপচাপ ক্যামেরা তাক করে দ্বীপের বসে রইলাম সবাই।

ফিচার বিজ্ঞাপন

সময় যেন আর ফুরোয় না। হরিণ কই! হরিণের দেখা নাই। সবাই যেন পালিয়েছে দূরের কোন বনে। সবার মধ্যে কেমন যেন হাতাশা ভিড় করছিল। হঠাৎ কিশোর ফিশ ফিশ করে উঠল। দেখ দেখ, ওই যে আসছে হরিণ। একে একে জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে লাগলো অগুনিত হরিণ। আমাদের তিনজনের ক্যামেরার শাটার যেন আর থামতে চায় না। হরিণ খেলা করে, কুস্তি করে, গাছের পাতা খায়, আমরা ছবি তুলে চলি। কখনো কখনো ক্যামেরার শাটারের শব্দে হরিণের কান খাড়া হয়ে যায়। আমাদের ছবিতে যোগ করে নতুন নতুন সব রোমাঞ্চকর মুহূর্ত। ছবি তুলতে তুলতে কখন যে সন্ধ্যা নামে আমরা টের পাইনা। ক্যামেরার মিটার যখন আন্ডার এক্সপোজার দিচ্ছিল তখনই বন্ধ করলাম ছবি তোলা। রাত নামতে শুরু করেছে। সুন্দর একটি দিনকে বিদায় দিয়ে বনের নৈশব্দ ভেঙ্গে আমাদের নিয়ে ট্রলারটি ছুটে চলে নামা বাজারের দিকে।

রাতে রিজর্টে ফিরে বেরিয়ে পড়ি নামা বাজার ঘুরতে। জেনারেটরের আলোয় ঝলমলে ছোট্ট বাজার। বাজারে তখনো ভিড় কমেনি। বাজারের এ মাথা থেকে ও মাথা আমরা ঘুরে দেখি। মহিষের দুধের মিষ্টি খাই দ্বীপ শেরাটন রেস্তোঁরায়। রাস্তায় ভাজা ঝিলাপি খাই পেটপুরে। রাতের খাবারটা বাজারেই সেরে ফিরে যাই রিজর্টে। পরদিন খুব ভোরে উঠে ফেরার পালা। বন্দরটিলা থেকে প্রথম খেয়া না পেলে লঞ্চ মিস হতে পারে। তাই সূর্য ওঠার আগেই আমরা ছুটে চললাম ঢাকার পথে।

কিভাবে যাবেনঃ ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সহজ রুটটি হলো- সদরঘাট থেকে লঞ্চে হাতিয়ার তমরশুদ্দি। এ পথে দুটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে। এমভি পানামা, ফোন- ০১৯২৪০০৪৬০৮ এবং এমভি টিপু-৫, , ফোন-০১৭১১৩৪৮৮১৩। ভাড়া ডাবল কেবিন ১২০০ টাকা, সিঙ্গেল ৬৫০ টাকা। ডেকে জনপ্রতি ভাড়া ২০০ টাকা। ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকেলে আর তমরশুদ্দি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে দুপুর সাড়ে বরোটায়। তমরশুদ্দি থেকে স্কুটারে বন্দরটিলা ঘাট ৪৫০-৫৫০ টাকা ভাড়া। যাওয়া যাবে ৩/৪জন। সেখানে ট্রলারে চ্যানেল পার হলেই বন্দরটিলা। সেখান থেকে নিঝুম দ্বীপের নামা বাজার যেতে হবে রিকশায়। ভাড়া ৮০-১৫০ টাকা। সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে রওয়ানা হয়ে পরদিন দুপুরে পৌঁছানো যাবে নিঝুম দ্বীপে।

কোথায় থাকবেনঃ নিঝুম দ্বীপে থাকার জন্য একমাত্র ভালো মানের জায়গা হলো অবকাশ পর্যটনের নিঝুম রিজর্ট। এখানে ২ শয্যার কক্ষ ভাড়া ১০০০ টাকা, ৩ শয্যার কক্ষ ১২০০ টাকা, ৪ শয্যার কক্ষ ১৮০০ টাকা, ৫ শয্যার ডরমিটরির ভাড়া ১০০০ টাকা, ১২ শয্যার ডরমিটরি ২৪০০ টাকা। ঢাকা থেকে এ রিজর্টের বুকিং দেয়া যায়। যোগাযোগঃ অবকাশ পর্যটন লিমিটেড, শামসুদ্দিন ম্যানশন, ১০ম তলা, ১৭ নিউ ইস্কাটন, ঢাকা। ফোন- ৮৩৫৮৪৮৫, ৯৩৪২৩৫১, ০১৫৫২৪২০৬০২।

প্যাকেজ ভ্রমণঃ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে নিঝুম দ্বীপে প্যাকেজ ট্যুরে নিঝুম দ্বীপ গেলে ঝামেলা ও খরচ দুটোই তুলনামূলক কম। ভ্রমণ সংস্থা অবকাশ পর্যটন এখানে নিয়মিত প্যাকেজ ট্যুরের আয়োজন করে থাকে। সংস্থার ব্যবস্থাপনা পরিচালক শিবলুল আজম কোরেশি জানালেন, তাদের আতিথেয়তায় গেলে পর্যটকদের তারা তমরশুদ্দি থেকে সরাসরি নিজস্ব ইঞ্জিন বোটে নিঝুম দ্বীপ নিয়ে যান। তার প্রতিষ্ঠান দুই ধরণের প্যাকেজ পরিচালনা করে থাকে এ জায়গায়। ঢাকা- নিঝুম দ্বীপ-ঢাকা, ৪ রাত ৩ দিনের এক্সিকিউটিভ প্যাকেজ মূল্য ৬৫০০ টাকা জনপ্রতি। ঢাকা থেকে তমরশুদ্দি লঞ্চের কেবিনে, সেখান থেকে ইঞ্জিন বোটে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ। আর কমপক্ষে ২০ জনের স্টুডেন্ট গ্রুপের জন্য এখানে ৪ রাত ৩ দিনের প্যাকেজ মূল্য ৩০০০ টাকা। এক্ষেত্রে লঞ্চের ডেকে তমরশুদ্দি, সেখান থেকে ইঞ্জিন বোটে একেবারে রিজর্টের দোরগোড়ায়। প্যাকেজ ট্যুরের জন্য যোগাযোগ করতে হবে অবকাশ পর্যটনের ওপরের ঠিকানায়।

কিছু তথ্যঃ নিঝুম দ্বীপে এখন হরিণের সংখ্যা বিশ হাজাররেরও বেশি। তারপরেও হরিণ দেখতে হলে এখানে ভ্রমণ কালীন সময়ে কিছু বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। বনে ঢুকলে নিঃশব্দে চলাচল করতে হবে। সামান্য হৈ চৈ করলে এখানে হরিণের দেখা মেলা দুস্কর। জঙ্গলে ট্রেকিং এর সময় যথা সম্ভব সবাই হালকা রঙের সুতি পোশাক পড়বেন। বন্য প্রাণীদের দৃষ্টি খুব প্রখর। অতি উজ্জ্বল পোশাকের কারণে দূর থেকেই আপনার আগমন টের পেয়ে যাবে ওরা। নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুৎ নেই। নামা বাজার এলাকায় রাত এগারোটা পর্যন্ত জেনাটরের মাধ্যমে বিদ্যুৎ থাকে।

সঙ্গে যা নেবেনঃ নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে আপনার ট্রাভেল ব্যাগটি যথা সম্ভব হালকা করার চেষ্টা করবেন। অতিরিক্ত কাপড় কিংবা কোন জিনিস পত্র সঙ্গে নেবেন না। একটি ভালো শীতের কাপড়, কান টুপি, রোদ টুপি, জঙ্গল শু, টর্চ, বাইনোকুলার, ক্যামেরা, ফিল্ম, ডিজিটাল ক্যামেরার জন্য পর্যাপ্ত মেমোরি কার্ড, দরকারি ঔসধ, ওরস্যালাইন ইত্যাদি নিতে ভুলবেন না।

আলোকচিত্র ও লেখা মুস্তাফিজ মামুন
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক

প্রাসঙ্গিক কথাঃ “ঢাকা বৃত্তান্ত”প্রচলিত অর্থে কোন সংবাদ মাধ্যম বা অনলাইন নিউজ সাইট নয়। এখানে প্রকাশিত কোন ফিচারের সাথে সংবাদ মাধ্যমের মিল খুঁজে পেলে সেটি শুধুই কাকতাল মাত্র। এখানে থাকা সকল তথ্য ফিচার কেন্দ্রীক ও ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহীত। “ঢাকায় থাকি”কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে এসব তথ্য একত্রিত করার ফলে তা ঢাকাবাসীকে সাহায্য করছে ও করবে। আসুন সবাই আমাদের এই প্রিয় ঢাকা শহরকে সুন্দর ও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলি। আমরা সবাই সচেতন, দায়িত্বশীল ও সুনাগরিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করি।

কুইক সেল অফার

Online Shopping BD (Facebook Live)



১,২১২ বার পড়া হয়েছে